তিন কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে শীত, সরকারি বাহিনীর লাঠিচার্জ আর জলকামান উপেক্ষা করে দিল্লিতে অবস্থান করছেন উত্তর ভারতের কৃষকেরা। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি-সংলগ্ন রাজ্যগুলো থেকে লাখো কৃষক জড়ো হয়েছেন। আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা করছে সরকার। ছোট একটি অংশের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছেন মন্ত্রীরা। কৃষকেরা শর্তাধীন বৈঠকের ডাক প্রত্যাখ্যান করেছেন, সরকারের দেওয়া খাবারও তাঁরা খাননি।

অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে কৃষকেরা পথে। একদিকে সরকারের নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে কৃষকদের লড়াকু মানসিকতা। গত কয়েক দশকে ভারতে এমন আন্দোলন দেখা যায়নি। ভারতীয় গণমাধ্যমে যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে বোঝা যায়, সরকারের নিপীড়ন নজিরবিহীন, কিন্তু কৃষকদের প্রতিরোধ অবিশ্বাস্য। হাজার-হাজার কৃষক সরকারের নিপীড়নের প্রাচীর ভেঙে এগিয়েছেন।

ভারতের চাল-ডাল-গম-আলুসহ বেশকিছু কৃষিপণ্য এত দিন কোনো সংস্থা কিনে মজুদ করতে পারত না। বিশেষ প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে বিবেচ্য হতো। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় এ বিশেষ প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা থেকে এগুলো বাদ দেওয়া হয়। ফলে ইচ্ছে করলে কোনো করপোরেট সংস্থা চাল-ডাল-গম-আলু কিনে মজুদ করতে পারবে। এ আইনের বিরুদ্ধেই বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেন পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ ছয়টি রাজ্যের কৃষকেরা।

আমাদের দেশে যাঁরা ভাবছেন এমন একটা আন্দোলন এ দেশে কেন দেখি না কখনো, তাঁরা আরো কিছু বিষয় বিবেচনায় নেবেন বলে আশা করি। ভারতীয় নাগরিক সমাজও সমর্থন জানিয়েছে কৃষকের এই আন্দোলনে। এমনকি আমরা দেখছি বলিউডের প্রখ্যাত নায়ক-নায়িকারা টুইট করছেন কৃষকদের প্রতি সমর্থন আর সমবেদনা জানিয়ে। আমাদের নাগরিক সমাজ, শিল্পী ও লেখক সমাজ কি এমন মনোভাব, উদ্যম আর সাহস দেখাবে এমন কোনো পরিস্থিতিতে?

সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য এই ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রামের, তা হলো কৃষক-শ্রমিকের ঐক্য। কৃষকের সংগ্রামে আশপাশ থেকে ছুটে এসেছেন শ্রমিকেরাও। সরকারও জোর গলায় বলতে পারছে না যে, এতে রাজনৈতিক ইন্ধন আছে। ভারতের এই কৃষক আন্দোলনে জাতপাত নেই, ধর্মীয় বিদ্বেষ নেই। এটি সমাজতন্ত্রীদের ভাষায় শ্রেণিসংগ্রাম বলা যাবে কি না, সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, ন্যায্য সংগ্রামই পারে বিভেদতন্ত্র আর সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করতে।

কৃষি হলো আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। এখনো কৃষি দেশের প্রায় ৫০ শতাংশের মতো মানুষের কর্মসংস্থান প্রদান করে। দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের জীবনযাপন কৃষিকে কেন্দ্র করে। এই করোনাকালেও প্রমাণ পাওয়া গেছে কৃষির শক্তি কতটা। যখন বেশির ভাগ শিল্প এবং সেবা খাত আত্মসমর্পণ করে বসেছে, বড় বড় শিল্পপতি হাত পেতেছে, তখন একমাত্র কৃষিক্ষেত্রই মাথা তুলে থেকেছে। আমাদের কৃষক জিডিপি নিয়ে ভাবেননি, তাঁদের নিজস্ব আয় নিয়ে চিন্তা করেননি। তাঁরা তাঁদের কর্মস্পৃহা আর উদ্যম দেখিয়ে গেছেন।

শ্রমিকবিরোধী, কৃষিবিরোধী, করপোরেট স্বার্থবাহী যেকোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে পাস হয়ে যায়, প্রতিরোধ হয় না। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশে তো কৃষকেরা ঠিকই বঞ্চিত, কিন্তু এমন কৃষক আন্দোলন কেন হয় না? এর উত্তর অনেকে অনেকভাবে দেবেন। আমি বলি, হয় না এ কারণে যে আমাদের রাজনীতি কৃষকের জন্য নয়। সৃজনশীলতার জন্য কৃষকদের বাহবা দেওয়া যায়, তাঁদের জন্য কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করা যায়, কিন্তু তাঁদের জন্য কিছু করা যায় না। ভর্তুকি বা সুবিধা যা দেওয়া হয়, বছর শেষে খাঁটি কৃষকের পাওনা কেবল তাঁর নিজের জন্য একটি গামছা আর লুঙ্গি, স্ত্রীর জন্য একটি অতি সাধারণ শাড়ি।

বাংলাদেশে জমি কমেছে, মানুষ বেড়েছে। ১৯৭১ সালে ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষ, আজ ১৭ কোটি। দেশের এই বিপুল জনসংখ্যার মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন কৃষকেরা। তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায় এই দেশের। কারণ, কৃষক যদি আর্থিকভাবে সুরক্ষাবোধ না করেন, তবে তিনি কৃষিকাজে উৎসাহ হারাবেন এবং কৃষিজমি ক্রমাগত অ-কৃষি কাজে ব্যবহৃত হতে থাকবে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া।

ভাগ্য ভালো যে, বাংলাদেশের কৃষকেরা শত কষ্ট আর দুঃখের মাঝেও কখনো কৃষিবিমুখ হননি। সরকার সার আর সেচে ভর্তুকি দেয়। কিন্তু দুটি সমস্যার কোনো কূলকিনারা হয়নি আজও। কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং ফসলের ন্যায্যমূল্যের অভাব বাড়ায় কৃষকের লাভ কমছে। অনেক কৃষকই হতাশ। কৃষকের এই হতাশা দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকেই দুর্বল করে তোলে।

বাংলাদেশে কৃষি গবেষণায় বড় বড় সাফল্য আছে। কৃষি গবেষণায় বাংলাদেশ আশেপাশের দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা সারা বিশ্বের কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু গবেষকদেরও স্বীকৃতি নেই সেভাবে। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা উন্নয়নের আরো অনেক সুযোগ রয়েছে। সমস্যাভিত্তিক গবেষণাকে বেছে নিতে হবে সময়ের চাহিদা মেটাতে।

তবুও সমস্যা আছে। কৃষক তাঁদের পরিশ্রম ও বিনিয়োগ থেকে যে আয় আর মুনাফা পাওয়ার কথা, তা পান না। পরীক্ষামূলক মাঠে যে ফসলটির উৎপাদন সাত টন, তা কৃষকের মাঠে তিন-চার টনে নেমে আসে। বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষকদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য।

গরিব কৃষকেরা তাঁদের কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য যথাযথ বিনিয়োগ করতে পারেন না। এ বিনিয়োগগুলো হলো ভালো বীজ, যথাযথ ভূমি কর্ষণ, সেচ, সার, কীটনাশক, অতিরিক্ত কৃষিশ্রম প্রভৃতি। উৎপাদন বাড়াতে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তার ওপরে রয়েছে ফড়িয়াদের উৎপাত। আছে যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাব, বাজারজাত ও পরিবহণের সংকট এবং অব্যবস্থাপনা। কৃষি উন্নয়নে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন কৃষি ঋণ, সঠিক বীজ বিতরণ প্রভৃতি।

শস্য বৈচিত্র্যকরণ, উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহারে নানা পদক্ষেপও আছে। সহায়ক মূল্যে সরকার কৃষকের কাছে যে ধান কেনে, সেটাও কৃষককে সাহায্য করে। এগুলোর বাইরে সরকার কৃষিতে কীভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে পারেন, সেটা ভাবতে পারে। ভবিষ্যতে কৃষিকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে সরকারি উদ্যোগ চাই, চাই সেরকম কৃষি ও কৃষকবান্ধব রাজনীতিও।

লেখা  সংগৃহীত

 

কলমকথা/বি সুলতানা